বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রেম ভালবাসা অনেক ধরনের হতে পারে যা লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু বিশাল আকাশের বুকে উড়ে বেড়ানো ও জলে স্থলে বিচরণ করা পাখিদের সাথে প্রেমে পড়া মানুষ খুঁজে পাওয়া কিন্তু বিরল বিষয়। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার ভূকশিমইলে এমনই এক পাখি প্রেমিকের সন্ধান পাওয়া গেছে তাঁর নাম মনসুর আলী (৭০)।
এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির তীরবর্তী কুলাউড়ার ভূকশিমইল ইউনিয়নের কালেশার গ্রামের অধিবাসী হলেন এই মনসুর আলী।। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। কুলাউড়ার বরমচাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০১৭ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এই শিক্ষকের বাড়িতে দেশীয় প্রজাতির পানকৌড়ির নিরাপদ অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে। বাড়ির কাছেই হাকালুকি হাওর হওয়ার কারণে পাখি গুলো অতি সহজেই সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ ও খেতে যেতে পারে অনায়াসেই। গ্রামের দু এক মাইল দূরে থাকা অবস্থাতেই শুনা যায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচির মিচিরের শব্দ। পাখির এই কিচির মিচির শব্দ শুনে মনে হয় এ যেনো এক অন্য পৃথিবী।
জলের পাখি পানকৌড়ি। গ্রামীণ জনপদের এই পাখিটি আগে অতি সহজেই দেখা যেতো হাওর পাড়ে জলের সাথে খেলা করতে কিন্তু বর্তমানে ঘন জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে ও পাখি শিকার করার কারণে দিন দিন এই পাখি বিলুপ্তির পথে তাই আগের মতো আর অবাধে বিচরণ করতে এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু শিক্ষক মনসুর আলীর বাড়ির ভেতরের গাছগাছালিতে পাখিদের নিরাপদ অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। বাড়ির উঠোনের সামনে গাছ ভর্তি বিভিন্ন প্রজাতির সাদা বক,সাদা কালচে বক,পানকৌড়ি ও বকের বাসা দেখে মনে হয় এ যেনো তাদেরই রাজ্য। এতো এতো পাখি,যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা। হাওর তীরে এসময়ে একসঙ্গে এতো পানকৌড়ি দেখতে পাওয়া অনেকটাই দুষ্কর। প্রায় দুই হাজার পানকৌড়ির একত্রে বসবাস এখানে। দূর থেকেই পাখির কিচির মিচির শব্দে টের পাওয়া যায় এখানেই পানকৌড়ির নিরাপদ অভয়াশ্রম। তাদের হাঁক-ডাক,খুনসুটি,উড়া-উড়ি আর খাবার সংগ্রহের ব্যস্ততাই জানান দেয় যে এখানে তারা কতটা নিরাপদ।
সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী সরেজমিনে এই পাখি বাড়িতে যান এসময় তিনি পাখি বাড়ির মালিক শিক্ষক মনসুর আলী ও তাঁর ছেলে ডা.মামুনের সাথে কথা বলেন। পাখির বিষয়ে তিনি বিভিন্ন খোঁজ খবর নেন।
বাড়ির লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেল, বাড়ির ফলজ গাছগুলো দখল করে নিয়েছে পানকৌড়ির দল গাছের ছোট বড় ডালে তারা গড়েছে তাদের আপন নিবাস। ইতিমধ্যেই তাদের ছোট্ট ছোট্ট সংসারে এসেছে নতুন নতুন বংশধর। কিন্তু সব খানেই ভালোর মধ্যেও থাকে কিছু কিছু খারাপ বিষয় তেমনই এলাকার কিছু দুষ্টচক্র পাখিদের অনিষ্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখানে পাখি ধরতে বা শিকার করার অপ্রচেষ্ঠায় লিপ্ত
থাকে একটি চক্র। পাখিদের এই নিরাপদ অভয়াশ্রমেও এক শ্রেণির দুষ্টু প্রকৃতির লোক প্রতিনিয়তই হানা দিচ্ছে পাখি গুলো শিকার করার জন্য। এদের কবল থেকে পাখিগুলোকে রক্ষা করতে বাড়ির লোকজনদের হিমশিম খেতে হয়।
জানা যায় এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি এখানে আসে নিরাপদ আশ্রয় আর খাবারের নিশ্চয়তায়। প্রথম দিকে পাখি গুলো তাদের বাসা তৈরিতেই ব্যস্ত সময় পার করে দেয়। বাসা তৈরি হলে মা পানকৌড়ি ডিম তা দেয়। ডিম থেকে বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী ও পুরুষ পানকৌড়ি পালাকরে বাসাতে থাকে। এখানে প্রতিটি পাখির বাসাতেই পানকৌড়ি আর সাদা বকের ছানাদের কিচির মিচির আওয়াজে চারিপাশটা মুখরিত হয়ে থাকে। যখন মাসখানেক পর ছানাগুলো একটু বড় হবে উড়তে শিখবে তখন নিজেরাই নিজেদের খাবার সংগ্রহ করতে পারবে তখন সেখান থেকে তারা অন্যত্র উড়াল দেবে।
এই বাড়ির লোকজন জানান ৭-৮ বছর থেকে এখানেই পাখিগুলো বসত গড়ে তুলেছে। বাড়ির পাশেই নদী ও হাওর থাকায় তারা সহজেই খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। তাই পাখি গুলো এখান থেকে কোথাও যায় না।
আলোকিত শিক্ষক মনসুর আলীর পরিবারে ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে সন্তান রয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন আবার অনেকে পড়াশোনায় রয়েছেন।
সরেজমিনে কথা হয় পাখি বাড়ির মালিক অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক মো.মনসুর আলীর সাথে। তিনি জানালেন
আমাদের প্রকৃতির সুন্দর্যের মূলে রয়েছে পশু পাখি। বর্তমানে লক্ষ করলে দেখা যায় আমাদের দেশের অনেক প্রজাতির প্রাণী আজ বিলুপ্তির পথে আর এই বিলুপ্তির কারণও আমরা। এই পৃথিবীকে নির্মল নিষ্পাপ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সবার আগে আমাদের কে জীবে প্রেম তৈরি করতে হবে তবেই তো সুন্দর ও নির্মল পৃথিবী গড়ে তুলা যাবে। মোঃ মনসুর আলী বলেন শিক্ষকতা থেকে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই এই পাখি গুলোই আমার সঙ্গী হয়ে গেছে আমি তাদের সাথে কথা বলি খাবার খেতে দেই তাদের কিচির মিচির শব্দ গুলো আমার কানে সংগীতের সুরের মূর্ছনার মতোই শুনায়। কিন্তু কষ্ট পাই তখনি যখন অকারণে কেউ তার লুলুপ্ত কারণে
পাখিকে আঘাত করে,বা শিকার করলে খুবই কষ্ট লাগে। এই পাখি গুলোর সাথে হ্নদয় থেকে প্রেম ভালবাসা আছে বলেই তো এই পাখিগুলোর সাথে আমার এতো সখ্যতা গড়ে উঠেছে। পাখি ধরা নিষেধ লেখা সম্বলিত প্লেকার্ড তৈরি করে বাড়ির চারপাশে লাগানো ছিল কিন্তু কিছু দুর্বত্তরা তা ছিড়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে। শিক্ষকসহ তাঁর ছেলে-মেয়েরাও এই পাখি গুলোকে ভালোবাসে তাই তো পাখি গুলো কে রক্ষা করতে চেষ্টা করে চলেছেন আপ্রাণ। বর্তমানে মোঃ মনসুর আলী বাড়িতে থেকেই পাখি গুলো কে পাহাড়া দিয়ে সময় কাটান। এভাবেই চলছে দীর্ঘ অনেক বছর ধরে।
স্থানীয় এলাকায় মাস্টার বাড়ি বলে এই বাড়ির অনেক সুনাম রয়েছে। শিক্ষকের বড়ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মামুন সিলেট মরিয়ম ইসাত হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।দ্বিতীয় ছেলে মাহমুদুর রহমান নাঈম সিলেট এমসি কলেজে গণিত বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। তৃতীয় ছেলে সাদিকুর রহমান সাদিক মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে বিবিএ অধ্যয়নরত। চতুর্থ ছেলে মাহফুজুর রহমান তানিম সিলেট পার্কভিউ মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত। পঞ্চম ছেলে আসাদুর রহমান দাইয়ান সিলেট মুহিবুর রহমান একাডেমীর ছাত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী। ষষ্ঠ ছেলে হাফিজুর রহমান মাহিয়ান মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়ে ইসরাত জাহান ইমা সিলেট এমসি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। দ্বিতীয় মেয়ে নুসরাত জাহান সুমা সিলেট আইডিয়াল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। তৃতীয় মেয়ে নিশাত জাহান দিনা এমসি কলেজ থেকে গণিত বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। ছোটমেয়ে ইফাত জাহান মীম সিলেট মুহিবুর রহমান একাডেমীতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত।
কথা হয় শিক্ষক মনসুর আলীর ছেলে ডা.মোস্তাফিজুর রহমান মামুনের সাথে। তিনি জানালেন,বাড়ির সবাই পড়ালেখা,শিক্ষকতা ও পেশাদারিত্বের কারণে সিলেট শহরেই বসবাস করছেন। কিন্তু পাখি প্রেমে তারা প্রায় সময় বাড়িতে আসেন এদের দেখভাল করেন। তারা জানালেন পাখির বিষ্ঠার কারণে বাড়ি জুড়ে মারাত্মক দুর্গন্ধ হয়। গাছাপালা ও শাক-সবজি কিছুই বাড়িতে চাষাবাদ করা যায় না। আর্থিক ক্ষতি হলেও প্রকৃতির প্রতি টান ও পাখিদের আশ্রয় দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি আরও জানালেন, এলাকার কিছু লোক প্রতি বছরই পাখি গুলোর বাচ্চা দেয়ার পর ছানা ও বড় পাখি ধরতে চায়। তা জবাই করে খেতে চায়। বাড়ির বাইরে নদী ও হাওরে পাখিগুলো খাবার সংগ্রহ করতে গেলে বাচ্চা গুলো শিকার করতে চায়। এ নিয়ে এই চক্রের সঙ্গে তাদের অনেক সময় ঝামেলা হয়। তাদের দাবি বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিভাগের সার্বিক তদারকি যদি থাকে তা হলে স্থানীয় এই দুষ্টু প্রকৃতির লোকজনের কবল থেকে সহজেই রক্ষা পেতো নিরীহ এই পাখিগুলো। তবে গেল দু’বছর ধরে কুলাউড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানা পুলিশ মাঝে মধ্যে এসে নজরদারি করাতে অনেকটাই নিরাপদে থাকছে পাখিগুলো।
এদিকে দেখা গেছে শিক্ষক মনসুর আলীর প্রতিবেশী মছব্বির আলীর বাড়ির গাছেও প্রায় শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির পাখি,পানকৌড়ি,ও সাদা বক তাদের আশ্রয় নিয়েছে।
জানা গেল হাকালুকির তীরবর্তী অনেক গ্রামেই দেশীয় ও পরিযায়ী পাখিরা এসে এখানে বাসা বাধে। কিন্তু বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিভাগের তেমন কোন তদারকি না থাকার কারনে পাখি গুলো অরক্ষিতই রয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি প্রেমী স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভের সঙ্গে জানান এ জেলার বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিভাগের কার্যক্রম কেবল কাগজে কলমে আর মৌখিক। তারা কর্মক্ষেত্রে আন্তরিক হলে হাওর অঞ্চলের পাখি গুলো প্রজননের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেত ও জীববৈচিত্র্যের-সৌন্দর্য অনেকটা রক্ষা হতো।
তবে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান হাওর অঞ্চলের পাখি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তারা নানা প্রদক্ষেপ নিচ্ছেন। খুব শিগগিরই তারা হাওর তীরবর্তী পাখি বাড়ি ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল গুলো চিহ্নিত করে তা পুস্তক আকারে প্রকাশ করবেন। এবং এরি আলোকে তারা তা সংরক্ষণেে সচেতন দৃষ্টি রাখবেন।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিনয় ভূষণ রায় জানান,ওই নিরাপদ পাখির অভয়াশ্রমের আশপাশের কিছু লোকজন পাখির ছানা ও বড় পাখি ধরে নিতে চায়। এমন খবর পেয়ে ওই বাড়িতে পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে আশপাশের লোকজনকে সতর্ক ও সচেতন করা হয়েছে। পাখি রক্ষায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা সক্রিয় থাকবে সব সময়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন,আমি পাখিবাড়িটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি প্রকৃতির প্রাণ হলো পাখি। পাখি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই তাদের নিরাপদ প্রজনন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে গাছে হাড়ি বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ভালবাসা শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমস্ত প্রাণীদের প্রতি ছড়িয়ে দিতে হবে।
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান,জেলার হাওর তীরবর্তী পাখিবাড়িসহ হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেয়া হবে।