চ্যানেল ওয়ান বিডি ডেক্সঃ
সম্মেলনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে ২০১৯ সালের ২৭ জুলাই সিলেট মহানগর এবং ২৯ জুলাই জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এরপর কেটে গেছে তিন বছর। মাত্র দুদিন পরেই শেষ হবে বর্তমান মহানগর কমিটির মেয়াদ। এরও দুদিন পর সিলেট জেলা কমিটিও হবে মেয়াদোত্তীর্ণ। কিন্তু বিগত ৩ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই ইউনিট কমিটি আটকে আছে মাত্র ৪ নেতায়। এদের মধ্যে ৩ জন আরো আগে থেকেই আছেন সিলেট যুবলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে।
কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বিভিন্ন সময় আশার বাণী শোনালেও,পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় আশাহত হয়ে পড়ছেন সিলেটের যুবলীগ নেতা-কর্মীরা। দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না থাকায় যুবলীগ নেতা পরিচয়ে সিলেটজুড়ে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন একাধিক ব্যক্তি। ধরা পড়লেও, এদের দায় নিচ্ছে না যুবলীগ। কমিটি না হওয়াকে কেন্দ্র করে জেলা ও মহানগর যুবলীগ কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ চরমে উঠেছে। বর্তমান অবস্থা দেখে পদ-পদবী পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই।
জানা গেছে,২০১৯ সালের ২৭ জুলাই অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে মাধ্যমে সিলেট মহানগর যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন ৫ বছর ধরে আহবায়কের দায়িত্ব পালন করে আসা আলম খান মুক্তি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মুক্তির কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মুশফিক জায়গীরদার। এর দুদিন পর ২৯ জুলাই সিলেট জেলা যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন প্রায় ১ যুগ ধরে সিলেট জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী শামীম আহমদ (ভিপি শামীম) এবং তার সাথে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন নতুন মুখ মো.শামীম আহমদ (সীমান্তিক শামীম)।
আপাতত এই চার নেতায় সীমাবদ্ধ সিলেট জেলা ও মহানগর যুবলীগ। বর্তমান কমিটির হাতে বৈধ সময় আর মাত্র ২ দিন। অথচ,গত ৩ বছরে একটি ওয়ার্ডেও সম্মেলন করেন নি যুবলীগের মহানগর শাখার সভাপতি সাধারণ সম্পাদক। পূণাঙ্গ হয়নি মহানগরের পূণাঙ্গ কমিটিও। যদিও একাধিকবার খসড়া কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেখেনি আলোর মুখ। আলম খান মুক্তি ও মুশফিক জায়গীরদার গত ৩ বছরে নগরীর কোনো ওয়ার্ডেই সম্মেলন বা কমিটি অনুমোদন করেননি।
একই অবস্থা সিলেট জেলা যুবলীগেও। ২০১৭ সালে সিলেটের কয়েকটি উপজেলার আহবায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ। তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ সাক্ষরিত ৩ মাস মেয়াদী ওই কমিটিগুলো পার করেছে ৫ বছর। সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম ও সাধারণ সম্পাদক শামীম ২০১৯ সালে দায়িত্বে আসার পর কোনো উপজেলা কমিটি ভাঙেন নি এবং নতুন কোনো কমিটিও গঠন করেননি। সম্মেলন তো দূরের কথা। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিগুলোর বেশিরভাগই গঠন হয়নি,কিংবা মেয়াদোর্ত্তীণ।
মহানগরের ওয়ার্ড এবং এবং জেলার উপজেলা কমিটিগুলো নিয়ে যেনো মাথাব্যাথাই নেই শীর্ষ ৪ নেতার। জেলা মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়েও আছে নানা বিতর্ক।
অভিযোগ রয়েছে, পূণাঙ্গ কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন না দিয়ে মাই ম্যান দের রাখতে মরিয়া যুবলীগের শীর্ষ নেতারা।
এদের মধ্যে আছেন হত্যা ও ছিনতাই মামলার আসামি,সাবেক শিবির ও ছাত্রদল কর্মী,অনুপ্রবেশকারী এবং নেতাদের স্বজন। এ নিয়ে তৃণমূলের ক্ষোভ চরমে উঠেছে। জেলা যুবলীগের কোন্দল থাকলেও তা প্রকাশ্যে আসে নি এখনো। কিন্তু মহানর যুবলীগে রয়েছে প্রকাশ্য বিভাজন। ২০১৯ সালের মহানগর যুবলীগের সম্মেলনে পরাজিত কয়েকজন প্রার্থীসহ পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদপ্রত্যাশী বেশ কয়েকজন নেতা মিলে তৈরি করেছেন একটি বিদ্রোহী প্যানেল। তারা ইতিমধ্যে মুক্তি ও মুশফিক অনুসারী যুবলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা ফাইল করে কেন্দ্রে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে কেন্দ্রীয় নেতাদের হোয়টসঅ্যাপে অভিযোগের ফাইলগুলোর পিডিএফ কপিও দিয়েছেন।
কমিটি আসছে এমন গুঞ্জনে পদপ্রত্যাশী অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছেন ঢাকায়। ধর্না দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। কমিটি হয়ে যাচ্ছে, শীঘ্রই হবে হচ্ছে এমন আশ্বাস শোনা যাচ্ছে বছরখানেক ধরেই। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে নাকি নতুন করে সম্মেলনের তোড়জোড় শুরু হবে, এ নিয়ে সন্দিহান তৃণমূলের কর্মীরা। কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ,রয়েছে একাধিক মামলাও।
সিলেটের নেতাকর্মীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে নামে হওয়া মামলার কাগজাদি,বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের লিংকসহ তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টের লিংক পাঠিয়ে আসছেন। সিলেটে এমনও হয়েছে,যুবলীগের কর্মী তার ঘনিষ্ঠ আরেক বন্ধুর নামে গোপনে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রে। এ সকল জটিলতার কারণেই ৩ বছর ধরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি পায়নি সিলেটের যুবলীগ।
বর্তমানে সিলেট জেলা ও মহানগর যুবলীগের ৪ পদবীধারী নেতা বিভিন্ন দিবসে দোয়া মাহফিল,ত্রাণ বিতরণ,পুষ্পস্তবক অর্পণ,মিছিল এবং মূল দল আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেই দায় সারছেন। কিন্তু যুবলীগকে সংগঠিত করতে তাদের মধ্যে নেই কোনো উদ্যোগ। মানবিক যুবলীগ হিসেবে বিভিন্ন প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হলেও,দেখা মিলছে না সুসংগঠিত যুবলীগের।
জেলা ও মহানগরের শীর্ষ ৪ নেতার সাথে বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায় বহু তরুণ ও যুবককে। কিন্তু তাদের নেই কোনো দলীয় পরিচয়। কেউ কেউ ছাত্রলীগের সাবেক পরিচয় নিয়েই চলছেন এখনো। তবে সকলেই নিজেদের দাবি করেন যুবলীগ নেতা কিংবা যুবলীগ কর্মী হিসেবে। তাদের কেউ আছেন মুক্তির পেছনে,কেউবা মুশফিকের। জেলা যুবলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা দুই শামীমেরও রয়েছেন বহু অনুসারী। এর বাইরে সিলেটের শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের বলয়ের যুবলীগ নেতাকর্মীও রয়েছেন অগণিত। লবিং তদবির সিলেট ছাড়িয়ে পৌছে যাচ্ছে কেন্দ্রেও। যুবলীগের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ,সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল এবং সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক প্রফেসর ডা.রেজাউল কবিরসহ অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও চলছে লবিং তদবির। পাশাপাশি একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে।
কিন্তু কবে আসবে জেলা ও মহানগরের কমিটি,তা জানেন না সিলেটের কর্মীরা। তারা বার বার আশায় বুক বাঁধেন,কিন্তু আশাহতও হন প্রতিবার। জুলাইয়ে শেষ হবে জেলা ও মহানগর কমিটির মেয়াদ। আগস্ট শোকের মাস,এ মাসে হবে না কোনো সম্মেলন এবং গঠন হবে না কোনো ধরণের কমিটি। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কমিটি আসবে কি না,তা নিয়েও সন্দিহান কর্মীরা। এমতাবস্থায় কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে সিলেটের যুবলীগ।
সিলেট জেলা যুবলীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম জানান, ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান পরশ স্যার ও সাধারণ সম্পাদক নিখিল ভাই আমাদের সিভি নিয়েছেন। তারা আমাদের জানিয়েছেন,নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। যদি না হয়,এই জেলা কমিটি ভেঙ্গে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। আমরা সিলেট জেলা যুবলীগের নেতাকর্মীরা সম্মেলনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি। এখন আমরা মানবিক যুবনেতা শেখ ফজলে শামস পরশ এবং মাইনুল হোসেন খান নিখিল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। তাদের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।
সিলেট মহানগর যুবলীগের বিগত সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী আব্দুল লতিফ রিপন বিদ্রোহী প্যানেলের কথা স্বীকার করে জানান,বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এর আগেও সিলেট মহানগর যুবলীগের আহবায়ক ও যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, তারা তখনও ব্যার্থ ছিলেন,এখনও ব্যার্থ। আগের ৫ বছর এবং এই ৩ বছরে তারা যুবলীগকে সুসংগঠিত করতে কোনো কাজই করেননি। তাদের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হবে ২৬ জুলাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা একটি ওয়ার্ডেও সম্মেলন করতে পারেননি। তারা বিভিন্ন দিবসে প্রোগ্রাম করার নামে চাঁদা উত্তোলন করেন।
রিপন ক্ষোভ ঝেড়ে আরো বলেন,আমরা পোড় খাওয়া ছাত্রলীগ। আমি এবং শান্ত দেব গত সম্মেলনে মহানগর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু আমাদের কাউন্সিলর লিস্ট পর্যন্ত দেখানো হয়নি। তারা তাদের মতো মনগড়া কাউন্সিলর বানিয়ে কাউন্সিল করেছেন। আমরা এর প্রতিবাদে কেন্দ্রে অভিযোগও করেছি। পরবর্তীতে আমাদের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগকে ঢেলে সাজালেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এলেন মানবিক যুবনেতা শেখ পরশ ভাই এবং নিখিল ভাই। আমাদের বুকে আবারও আশার সঞ্চার হয়। গত বছর ধরে সিলেটের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের তোড়জোড় চলছে। কিন্তু প্রকৃত ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ১/১১ পরবর্তী সময়ে আসা জামা শিবির ছাত্রদলের কর্মী,হাইব্রিড,চাঁদাবাজ,ছিনতাইকারী,মামলার আসামি এবং আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেন মুক্তি ও মুশফিক। সিলেট মহানগরের স্থায়ী বাসিন্দাদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন উপজেলার এমনকি সিলেট জেলার বাইরের লোকজনকে কমিটিতে ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়। আমরা এর প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় যুবলীগের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। ফলে এখনো আটকে আছে সিলেট মহানগরের কমিটি। আমাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পান তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু হাইব্রিডদের নিয়ে গঠিত কমিটি সিলেটের তৃণমূল নেতাকর্মী মেনে নেবে না। যেহেতু,বর্তমান ব্যার্থ কমিটির মেয়াদও প্রায় শেষ পর্যায়ে,তাই সিলেটের যুবলীগ নেতাকর্মীর দাবি,এই কমিটি ভেঙ্গে প্রকৃত কর্মীদের ত্যাগ,শ্রম,ঘাম ও রক্তের মূল্যায়ন করে সিলেট মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হোক।
তবে সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম আহমদ (ভিপি শামীম) জানান,আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিয়েছি। খুব শীঘ্রই কমিটি আসবে ইনশাআল্লাহ।
সিলেট মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার বলেন,আমরা প্রায় ৯ মাস আগে পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা কেন্দ্রে জমা দিয়েছি। করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন কারণে এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন পায়নি। তবে আশার কথা হলো,শীঘ্রই মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর আমরা ওয়ার্ড কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করব।
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা প্রফেসর ডা.রেজাউল কবির বলেন,আমরা যাচাই বাছাই করছি। বাছাই প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। বাছাই শেষ হলেই সিলেট জেলা ও মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে।
পদপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন,হ্যা আমরা সবকিছু মিলিয়েই যাচাই করছি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন হয়ে গেলেই ওয়ার্ড এবং উপজেলাগুলোর সম্মেলন শুরু হয়ে যাবে।