বিলুপ্তির পথে বেদে সমাজের বৈচিত্র্যময় জীবনগাঁথা – Channel One BD
সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫, ০৯:৪১ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজঃ
টাঙ্গাইল নাগরপুরের বেলতৈলে ফুটবল ফাইনাল টুর্নামেন্ট’২৫ অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে ব্যস্ত সময় পার করলেন জননেতা মোঃ শরীফুল ইসলাম স্বপন বানিয়াচং উপজেলায় দুপক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহতের ঘটনায় উসমান নামের একজন গ্রেফতার মিশিগানে ঈদ সাবেক তালামীযের দায়িত্বশীল নিয়ে ঈদ পূর্ণমিলনীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন পবিত্র ঈদুল আযহা আপনাদের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ, শান্তি ও আনন্দের ঘনঘটা- ওসি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ঈদুল আযহা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি আত্মত্যাগের প্রতীক- জননেতা মোঃ হাবিবুর রহমান হবি পবিত্র ঈদুল আযহা সকলের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ শান্তি ও আনন্দের ঘনঘটা- জননেতা মীর আবুল কালাম আজাদ রতন পবিত্র ঈদুল আযহার কোরবানির এই ত্যাগের মাধ্যমে প্রিয় বাংলাদেশ থেকে মুছে যাক সকল অপশক্তি – জননেতা মোঃ মাইনুল আলম খান কনক ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত পবিত্র ঈদুল আযহা সকলের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ, শান্তি ও আনন্দের ঘনঘটা – জননেতা মোঃ শরীফুল ইসলাম স্বপন মহান আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদুল আযহা- জননেতা মোঃ আতিকুর রহমান আতিক

বিলুপ্তির পথে বেদে সমাজের বৈচিত্র্যময় জীবনগাঁথা

ফারহানা বেগম হেনাঃ

সিঙ্গা লাগাই,দাঁতের পোক ফালাই,সাপের খেলা দেখাই-বেদেনীদের এমন সুর এখন আর কারও মনে নাড়া দেয় না। আগের মতো কেউ আর চাল,ডাল,শাক-সবজির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাটে যান না। বদল প্রথা নেই আর এ সংসারে। অর্থের প্রবল নেশায় স্থলের মানুষেরা ভাতের সঙ্গে মাছ আর বস্ত্র আছে কিনা,খবর রাখে না কেউ। আসহায় হয়ে পড়েছে এসব মাছ ধরা লোকগুলো। বেদেরা স্থলে আর নদীতেই মানতাদের সংসার। কেমন আছে ঠিকানাবিহীন জীবনে এ যাযাবর বেদে ও মানতা সম্প্রদায়রা। নিজ ভূখণ্ডে বাস করেও যারা পরবাসী! সমাজ সভ্যতা গড়ার কাজে প্রতিনিয়ত নিবেদিত প্রাণের লোকগুলো কেমন আছে? বিষধর সাপ নিয়ে খেলা,বিষাক্ত জীবন নিয়েই তাদের বসবাস। এক সময় নৌকা নিয়ে নৌপথে চলাচল করত এ সম্প্রদায়রা। এখন নৌপথেই বাঁধ,স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে নৌকা নিয়ে চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে বেদেদের। বেদেরা এখন সড়কপথে এসে পথ থেকে প্রান্তরে জনগুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজারের সংলগ্নে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করে। সাপ খেলার পাশাপাশি বেদেনীরা তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের মেঠোপথে। তবে দিন দিন এ বেদে সম্প্রদায় সাপ ধরার নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নানা পণ্য এখন তাদের হাতে উঠেছে। বেঁচে থাকার নিরান্তর সংগ্রমেই আজ তাদের ভিন্ন পথে চলা বৈকি। তারপরও যারা এ পেশাকে আগলে রেখেছে তাদের জীবন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

উল্লেখ্য,বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সমস্যাসংকুল হলো বেদে সম্প্রদায়ের জীবন। এরা মূলত আমাদের দেশে বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত একটি ভ্রাম্যমান জনগোষ্ঠী। অনেক সময় এরা যাযাবর নামেও পরিচিত হয়ে থাকে। কথিত আছে,১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজার সঙ্গে এরা ঢাকায় আসে। পরে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। এরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে,এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ছড়িয়ে পড়ে। তাদের আদি নাম মনতং। বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা,পরিমার্জিত বৈদ্য থেকে উদ্ভূত। অধিকাংশ বেদেই হাতুড়ে চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। তাই তারা নিজেদের মনতং বলে পরিচয় দিতে বেশি আগ্রহী। যুদ্ধ ও শিকারে অতিশয় দক্ষ বেদেরা কষ্টসহিঞ্জু ও সাহসী। তাদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতো। বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এই ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা ভাষা-ভাষীর সঙ্গে তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। উল্লেখ্য এই ঠেট ভাষার সঙ্গে আরাকানদের ভাষার মিল আছে। তাদের ভাষায় ব্যবহৃত অধিকাংশ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত। বেদেরা কৌম সমাজের রীতিনীতি মেনে চলে ও দলবদ্ধ হয়ে থাকে।

গোত্রপ্রীতি প্রবল বলে সদস্যরা একে অন্যকে নানাভবে সাহায্য করে থাকে। বেদেদের সমাজ পিতৃপ্রধান হলেও মেয়েরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেদে ছেলেরা অলস প্রকৃতির। সব রকমের কঠোর পরিশ্রম মেয়েরাই করে থাকে। বেদেরা সাধারণত সমতল ভূমিতে নদী-নালার আশপাশে দলবদ্ধভাবে মাচা তৈরি করে অথবা নৌকায় বাস করে।

তাছাড়া জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম এরা নৌকাতেই সেরে থাকে। নৌকাই সাধারণত তাদের আবাসস্থান এবং একমাত্র অবলম্বন। কোনো নদী বা খালের কিনারায় সারি সারি ছোট ছোট অসংখ্য ছইওয়ালা নৌকা বাধা থাকলে বোঝা যায় এগুলো বেদে নৌকার বহর।

নৌকাই তাদের জীবন-জীবিকার সব। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এক নগর থেকে আরেক নগরে ঘুরে বেড়ায় নৌকা দিয়ে। তাই নৌকা তাদের জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বেদেরা সাপ ধরে খেলা দেখায় এবং সাপের বিষ বিক্রি করে। এছাড়া তারা তাবিজ-কবজও বিক্রি করে। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তারা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে পরিভ্রমণ করে। এই পরিভ্রমণকে বেদেদের ভাষায় গাওয়াল বলে। মহিলারাই বেশী গাওয়ালে যায়। তাদের সঙ্গে থাকে সাপের ঝাঁপি বা ঔষুধের ঝুলি। এরা সপরিবারে গাওয়ালে যায় শীতের শুরুতে অগ্রাহায়ন মাসের শেষের দিকে ও আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার্ধে।

প্রথম দফায় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ও দ্বিতীয় দফায় আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় এরা গাওয়াল করে। গাওয়ালের সময় এরা স্থানীয়ভাবে মূলত নৌকা,তাঁবু বা কোনো স্কুল ঘরের বারান্দায় সপরিবারে থাকে।

গাওয়াল শেষে দলবদ্ধভাবে আবার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসে। গাওয়ালে তারা হেটে যায় কিংবা নৌকা ব্যবহার করে। বেদেনীরা যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় তখন পুরুষ বেদেরা নৌকায় থেকে তাদের ঘর-সংসার,ছেলেমেয়ে দেখাশোনা করে। বেদেনীরা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন গ্রাম,পাড়া বা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে কাচের চুড়ি,কানের দুল,ফিতা, সাবান,নাক ফুল,রুলি ইত্যাদি বিক্রি করে আয়-রোজগার করে।

বেদে সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত। ভাসমান জীবনযাপনের ফলে তারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাছাড়া দারিদ্র্যও তাদের শিক্ষার সুযোগ গ্রহণের অন্যতম অন্তরায়। শিক্ষার আলো না থাকায় বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। কুসংস্কার ও উদাসীনতার কারণে তারা চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বেদেরা নদীর যে পানিতে প্রাকৃতিক কাজ সারে,সেই পানি আবার গোসল,রান্নাবান্না ও খাওয়ার কাজে ব্যবহার করে। ফলে তারা বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

দেশে ২০০৮ সালে বেদেদের প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার দেয়া হয়। যুগ যুগ ধরে তারা নাগরিক জীবনের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ৯৮ শতাংশ সদস্য দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বেদে সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ পানি কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সংকট। সাধারণ মানুষ বেদেদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চোখে দেখে। তাদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না। জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আর আশার আলো দেখে না।

বেদেদের জীবন দুঃখ-কষ্ট আর নানা সমস্যায় জর্জরিত। নাগরিক নানা অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। বেদে পরিবারের শিশুরা সব সময় পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। তাদের চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের বেশিরভাগ প্রকৃতির লতাপাতা ও গাছগাছড়ার মাধ্যমে ওষুধ তৈরি করে রোগ নিরাময় করে থাকে।

উপার্জনের মৌসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বেদেদের বিয়েতে অ্যাপায়ন কিংবা উপহার প্রদানের কোনো নিয়ম নেই। বেদেদের মাঝে বাল্যবিয়ে ও বহুবিয়ের প্রচলন তেমন একটা দেখা যায় না। বেদে যুবক-যুবতীরা স্বেচ্ছায় পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়েতে সম্মত হয়। বর-কনেসহ উপস্থিত সবাই নেচেগেয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। পছন্দের মেয়েটিকে এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। বেদেদের বিয়ে ভেঙে দেয়ার নিয়মও বেশ সহজ। স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তাদের তালাক হয়ে যায়। বিয়ে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটলেও বেদে মেয়েরা কখনোই ভেঙে পড়ে না। বর্তমানে বেদেদের বিয়ের রীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কিছু কিছু বিয়ে বর্তমানে সরকারি খাতায় রেজিস্ট্রি হচ্ছে।

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ বেদেদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও পেশাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ফলে তাদের পুরোনো কবিরাজি ও তাবিজ-কবচ প্রথা মানুষকে তেমন একটা টানে না। মানুষ এখন আর সাপ খেলা,কিংবা জাদুবিদ্যায় তেমন আগ্রহী হয়ে ওঠে না। দিন দিন বেদেদের সাপ ধরা প্রথাও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বেদেনিদের শিঙ্গা এখন আর কেউ লাগায় না। কেউ দাঁতের পোকা ফেলে না। আগের মতো কেউ এখন আর চাল,ডাল ও শাকসবজির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাটে যায় না। বেদেরা নিরুপায় হয়ে নৌকা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করছে। তাদের টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

পৃথিবীতে সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরোত্তর বিকাশ ও সমৃদ্ধি সাধিত হচ্ছে। কিন্তু বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের আজও কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। তাদের জীবনে আসেনি সামাজিক মর্যাদা,কিংবা ইতিহাস,ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির তৃপ্তি।এমনকি শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো অত্যাবশীয় অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত।আধুনিক সমাজ তাদের মানুষ হিসেবেও স্বীকৃতি দিচ্ছে না।তাদের নিয়ে ভাবার কিংবা তাদের নিয়ে কথা বলার জন্য কেউ এগিয়েও আসছে না।সমাজের একটি অংশকে বাদ দিয়ে একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি কখনোই সম্ভব নয়।প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই অধিকার রয়েছে সামাজিক মর্যাদার সাথে অত্যাবশীয় অধিকারের সাথে জীবনযাপন কারার। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে জন্য তাদেরকে ভাসমান জীবনযাপন থেকে সরিয়ে আনা,তাদের অত্যাবশীয় নাগরিক অধিকার,বেদে সম্প্রদায়ের পেশাকে অক্ষুন্ন রেখে তাদেরকে সামাজিক ভাবে মর্যাদা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।বেদেরা হারিয়ে গেলে আমাদের ইতিহাস,ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটি অংশ চিরতরে হারিয়ে যাবে।ইতিহাস,ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার আগেই তা রক্ষা করা উচিত।



Our Like Page