মৃণাল কান্তি দাসঃ
নবী করিম (সা.)সাধারণ কেউ নন। উনি নিঃসন্দেহে একজন মহামানব। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত যিনি জেনেছেন তিনি নবীজীকে একজন মহামানব বলেই মেনেছেন। আর এ কারণেই তিনি পৃথিবীব্যাপী বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের হৃদয়ের সর্বোচ্চ স্থানটি দখল করে আছেন বহুযুগব্যাপী। এমন একজন মহামানবকে নিয়ে যেকোনো প্রকার মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যকারীগণকে নিজেদের যোগ্যতা অনুভব করা উচিত। বুঝতে পারা উচিৎ নিজের অবস্থান কোথায় আর কাকে নিয়ে কথা বলছেন। অন্ধের মতো নিজের বিশ্বাসকে ধারণ করে অন্যের বিশ্বাসের উপর আঘাত করাটা চরম মূর্খামী এবং অবশ্যই ঘৃণ্যতম রুচির পরিচায়ক।
ধর্মীয় আবেগের উপর আঘাত করার ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই এই পৃথিবীতে নিজেদেরকে আস্তিক এবং ধার্মিক দাবী করা ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশিবার অন্য ধর্মের মহামানবদের বিষয়ে অসংলগ্ন, অপ্রয়োজনীয়, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও কুরুচিপসম্পন্ন মতামত পোষণ করে আসছেন এবং সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করেই আসছেন। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে নিরীহ জনসাধারণকে। এই কাজের মাধ্যমে তারা ক্রমেই নিজের আশ্রিত ধর্মকে বিতর্কের স্থানে এনে দাঁড় করাচ্ছেন এবং যার ফলে পৃথিবীতে নাস্তিকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাপক হারে।
ধর্ম" কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতার নাম নয়। অন্য ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করে নিজ ধর্মকে বিজয়ী প্রমানের কোনো বিধান জগতের কোনো ধর্মেই প্রদান করা হয় নি। তাহলে কেনো এইসকল আক্রমনাত্মক মন্তব্য, কেনো এই হেয় করে দেখানোর আগ্রহ? দেখা যায় নিজের আশ্রিত ধর্মের চর্চার চেয়ে ভিন্ন ধর্মের ত্রুটি খুঁজার কাজেই তথাকথিত ধর্মিকসমাজ বিশেষরকম সোচ্চার। এই প্রবনতাই তৈরি করছে ধর্মীয় সংঘাত, তৈরি করছে বিনাশের সোপান। এদের কারণেই সমগ্র মানব সভ্যতা আজ দাঁড়িয়েছে বিপন্নতার দ্বারে।
ভারতবর্ষের একটা বিষবৃক্ষের নাম হলো সাম্প্রাদায়িক সংঘাত। এই বিষবৃক্ষের ফল হিসেবেই বিভক্ত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুজলাসুফলা এই রত্নভাণ্ডার। তৈরি হয়েছে আলাদা দুটো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র এবং বহন করে চলছে চিরকালীন এক সংঘাত। যার প্রভাব ভোগ করে চলছে উপমহাদেশের অগণিত নিরপরাধ, নিরপেক্ষ মানুষ আর অঞ্চলটি ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে জ্ঞানে এবং উন্নতিতে।
ভারতের উগ্র-সাম্প্রাদায়িক রাজনৈতিক দল হলো ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজিপি)। প্রাথমিক সদস্যপদের দিক থেকে এটি বিশ্বের বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। বিজেপির ঘোষিত আদর্শ ছিলো- ‘একাত্ম মানবতাবাদ’। ১৯৬৫ সালে দীনদয়াল উপাধ্যায় প্রথম এই মতবাদ প্রচার করেছিলেন। তিনি এই দর্শনকে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, এটি ‘এমন এক স্বদেশি অর্থনৈতিক মডেলের পক্ষপাতী যা মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল অন্য ধর্মগুলিকে বাদ দিয়ে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং সেই অর্থে বিজেপি একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। নিজেদের নানাবিধ অপকর্মের মাধ্যমে তারা ইতিমধ্যে নিজেদের সেই হীন মনোবৃত্তিকে জানান দিয়েছেও। এই মৌলবাদীদের হিংসাত্মক ধর্মই বারংবার অধর্মকে প্রতিষ্টা করে চলছে।
সম্প্রতি, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা এক টেলিভিশন বিতর্কে মহানবী(সা.)বিষয়ে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ এবং আক্রমনাত্মক একটি মন্তব্য করেছেন! তার সেই মন্তব্যকে সমর্থন করে দলটির দিল্লি শাখার মিডিয়া ইউনিটের প্রধান নভিন জিন্দাল একটি টুইটও করে দিয়েছেন! এই দুই ব্যক্তি নিশ্চয়ই নিজেদেরকে হিন্দু ধার্মিক দাবী করেন। প্রশ্ন হলো- হিন্দু ধর্মের কোন বিধানে, কোন পুরানে, কোন উপনিষদে অন্য ধর্মের একজন মহামানবের বিপক্ষে আক্রমনাত্মক মন্তব্য করে মানুষে মানুষে সংঘাত তৈরির বিধান কিংবা নূন্যতম কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে? তাদের সেই গর্হিত কাজটির কারণে আজ সমগ্র বিশ্বের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে চরম আঘাত আসতে চলেছে। বহুপথ হেঁটে মানুষে মানুষে যে বিশ্বাস ও বন্ধনের সেতু নির্মিত হয়েছিলো আজ সেটাতে ভাঙনের ছোঁয়া এসে লাগছে! বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার সমস্ত সম্পর্কের সম্মান, মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে চলছে!
আমি জানি না ঠিক কোন ভাষায় নিন্দা জানালে এই দুই ব্যক্তিকে উপযুক্ত ঘৃণা জানানো সম্ভব হবে! আমি ঠিক জানি না কোন ভাষায় সান্ত্বণা জানালে বিশ্বের অসংখ্য নবীপ্রেমিকের মনকে একটুখানি শান্ত করা যাবে, তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যাবে। শুধু এটুকু বলতে পারি- ভিন্ন মতাদর্শী হলেও আমার মতো অগণিত সাধারণ মানুষ আছি যারা নবীজীকে সত্যিই শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি এবং মহামানব হিসেবে সম্মান করি। এই মূর্খ এবং তথাকথিত ধর্মজীবীদের অসংলগ্ন, অসামাজিক মন্তব্যে আমরাও সম আঘাতপ্রাপ্ত এবং আইনগত ও দৃষ্টান্তস্বরূপ বিচার দাবি করি।
একজন মানব হিসেবে প্রত্যেক মহামানবের কর্মকে সম্মান ও সমীহ করা চলাই উচিৎ কর্তব্য সেটা তিনি যে ধর্মেরই বাহক হোন না কেনো। কেউ যখন সেই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হন তখন তিনি প্রথমেই হারান নিজের ধর্মকে অতঃপর হারিয়ে ফেলেন নিজের মানব পরিচয়কেও। তখন তিনি পরিনত হন পশুতে, পরিনত হন আবর্জনায়।
বুদ্ধি থেকে অদ্যাবধি আমি শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্রের যত বন্দনা করেছি নবী করিম হযরত মুহম্মদ(সা.) কেও ততটাই বন্দনা করেছি। বিশ্বনবীর জন্মদিনেই আমি লিখেছিলাম আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতাখানি (বিশ্বনবীর জন্মদিনে/কাব্যগ্রন্থ-যুদ্ধ এবার শুদ্ধ হবার)। যীশু খ্রিষ্ট এবং বুদ্ধদেবকেও ততটাই সম্মানপূর্ণ সম্বোধন করে এসেছি। এই কাজটির জন্য নাতো আমার ধর্ম বিবর্জিত হয়েছে আর নাতো আমার কোনো অর্ধম হয়েছে। বরং উদার চিত্তে এসেছে প্রশান্তি, এসেছে সম্মান আর সুখ। যে বিশ্বাস, যে কাজ, যে আশ্রয় আর আদর্শ মানব আত্মাকে করুণার ছোঁয়া দেয়, প্রেমের সন্ধান দেয় সেই কর্মই মানুষের ধর্ম। এই বোধটুকু যাদের নেই তারা কখনোই ধার্মিক হতে পারেন না কেবল নূপুর-নভিনের মতো কুরাজনৈতিক হয়ে বেঁচে থাকেন। সময়ের অন্তে এদের ঠাঁই হয় নর্দমায়।
পরিশেষে, বিশ্বনবীর চির উদারচরিত সেই কথাটিই উদ্ধৃতি হিসেবে এখানে ব্যবহার করতে চাই- "এদের জ্ঞান দাও, প্রভু..."।
এদের জ্ঞান দাও, প্রভু
লিখেছেন সময়ের জনপ্রিয় লেখক,কবি ও শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাস
০৮-০৯ জুন ২০২২খ্রি.
সম্পাদকঃ মো শফিকুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক: কাজী মোস্তফা রুমি, বার্তা সম্পাদকঃ ফারহানা বি হেনা।
বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল।
Copyright © 2025 Channel One BD. All rights reserved.