চ্যানেল ওয়ান বিডি ডেক্সঃ
ছাতকে বন্যার প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া সাগর সরকার যেভাবে বেঁচে গেলো,সে এক করুণ কাহিনী। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে সাগর সরকার(২৫)। সে ছাতক সদর ইউনিয়নের তিররাই গ্রামের ব্যবসায়ী রনজিত সরকারের পুত্র। নিখোঁজের দিন ছিলো বৃহস্পতিবার। ছাতক শহর থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন সাগর সরকার ও আছাদ আহমেদ নামের আরেক ব্যবসায়ী। শহরে সাগর সরকারের ফার্মেসী ব্যবসা আছে। বন্যার পানি খুব বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে তারা পায়ে হেঁটেই যাচ্ছিলেন। এলাকার সাথে একেবারেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। পায়ে হাটা ছাড়া কোন গতন্তর ছিলোনা। দুই জন ব্যবসায়ীই যুবক এবং স্মার্ট। শ্যামপাড়া- কান্দিগাও রাস্তা দিয়ে হাটছিলেন তারা দুইজন। মদুকোনী গ্রামের দক্ষিণ পাশে সড়কে একটি বিশাল ভাঙ্গার সৃষ্টি হয়ে ইতিমধ্যে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানিতে নেমে তারা রাস্তার ভাঙ্গা অংশটুকু পাড়ি দিতে গেলে প্রবল স্রোতের টানে তলিয়ে যায় সাগর সরকার ও আছাদ আহমেদ। পরে অনেক চেষ্টা করেও তারা আর তীরে উঠতে পারেনি। স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে কে- কোন দিকে চলে গেছে তাও তারা বলতে পারছেনা। রাতে তেরা বিল নামক স্থান থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আছাদ আহমেদকে। সে জানায় আল্লাহ রহমতে হয়তো একটি ছোট নৌকা নিয়ে তার পাশ দিয়ে কেউ যাচ্চিলো এমন অনুমান করে বাঁচাও- বাঁচাও বলে চিৎকার করলে কেউ তাকে নৌকায় তুলে নেয়। নৌকার লোকেরা তাকে মুক্তিরগাও গ্রামের তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে যায়। জীবনের আশা ছেড়ে দেয়া আছাদ আহমেদ জানায় কিছু সময়ের মধ্যেই হয়তোবা সে মারা যেতো বা বাঁচাও বলে চিৎকার করার শক্তি থাকতো না তার মধ্যে। সে ফিরে আশার পর ওখান থেকে খোঁজ পাওয়া যায় তার সাথে সাগর সরকার ও নিখোঁজ হয়েছিল। সাগর সরকারের বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে। নৌকা নিয়ে হাওরে সারা রাত তাকে খুঁজা-খুঁজি করা হয়েছে। কিন্তু সাগর সরকারের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। চারদিকে খবর ও ছড়িয়ে পড়েছে বন্যার পানিতে তলিয়ে সাগর সরকার মারা গেছে। এ দিকে সাগর সরকার পানির স্রোতে কখনো ভাসছে আবার কখনো ডুবছে এভাবে ভাসতে-ভাসতে একটি বরই গাছের ডালে ধরতে সক্ষম হয় সে। জীবনের আশা বাদ দেয়া সাগর সরকার ররই গাছের ডাল পেয়ে জীবনে বেঁচে যাওয়ার কিছুটা আলো দেখতে পায়। কিন্তু এতক্ষণে ঢেউ আর ঠান্ডা পানিতে তার শরীরে শক্তি বলতে কিছুই নেই। গভীর অন্ধকার রাত আর মুষলধারে বৃষ্টি এর মধ্যে সাপ-বিচ্ছুর ভয় তাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। ররই গাছের একটি ডালে ধরে আটকে থাকলেও ঢেউয়ের আছাড়ে অন্য ডালগুলো তার পিঠ ও মাথায় আঘাত হানতে থাকে। শরীরে বরই গাছের কাঁটা বিধতে থাকে। এভাবে প্রায় ৪/৫ ঘন্টা কাটানোর পর বরই গাছের কাঁটার আঘাত আর সহ্য হচ্ছেনা। এই মুহুর্তে পশ্চিম দিকে গাছের ঝোপের মতো একটি ঝোপ অনুমান করা যাচ্ছে। হয়তো বা কারো বাড়ি – ঘর ও হতে পারে। এই ভেবে আবারো সাঁতরিয়ে অগ্রসরের চেষ্টা। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারলেও একসাথে কয়েকটি গাছের দেখা পেয়েছে সে। একটি গাছে আঁকড়ে ধরে ধীরে – ধীরে গাছের একটি ডালে ধরে ও একটি ডালে পা রেখে ভয়ে- ভয়ে এভাবেই রাত পার করছে সাগর সরকার। এলাকাটি ছিলো ছাতক সদর ইউনিয়নের মাছুখালি। মুখে ভাষা নেই,শরীরে শক্তি নেই। এ অবস্থায় রাতে তাকে খু্ঁজা- খুঁজি করা হচ্ছে, অদুরে তার বাবা রনজিত সরকার, সাগর -সাগর বলে চিৎকার করছেন। বাবার চিৎকার তার কানে আসছে কিন্তু সে এখানে আছে এমন কথা মুখ দিয়ে বলতে পারছেনা। এই শক্তি তার মধ্যে এখন আর নেই। প্রায় ১৩ ঘন্টা পানির সাথে লড়াই করতে – করতে সে একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তার বাবাসহ স্বজনরা সারারাত খুঁজা- খুঁজি করার পর জীবিত সাগর সরকারকে উদ্ধারের আশা বাদ দিয়েছেন। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে। শুক্রবার সকালে গাছ- গাছালির পাশ দিয়ে একটি ছোট নৌকা নিয়ে যাচ্ছিলেন কান্দিগাও গ্রামের ২ ছেলে। এ সময় সাগর সরকার তাকে উদ্ধারের জন্য তাদেরকে ডাক দিলে তারা নৌকা নিয়ে তার কাছে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। সে তার পরিচয় দিলে তারা তাকে বড়িতে পৌঁছাতে পারেনি। তীব্র স্রোতের কারণে ওই দিকে নৌকায় করে যাওয়া যাচ্ছিলো না। সাগর সরকার কে মুক্তিরগাও গ্রামের ভেতর একটি ব্রিজের উপর রেখে তারা চলে যায়। ব্রিজ থেকে মুক্তির গাও গ্রামের রাস্তায় সাঁতার কেটে ছাতক ডিগ্রী কলেজের হিসাব রক্ষক আব্দুর রহিমের বাড়িতে উঠে সাগর সরকার। ওই বাড়িতে তার শরীর থেকে অজস্র কাঁটা খুলে প্রথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। পরে বাড়ির লোকজন তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়। বর্তমানে সাগর সরকার সুস্থ আছে বলে জানিয়েছেন তার বাবা রনজিত সরকার।